বাংলাদেশের বেশিভাগ মানুষ প্রবাসীদের কামলার চোখে দেখে। নিজের মেয়েকে নেশাখোর ছেলেদের সাথে বিয়ে দিবে তবুও প্রবাসীদের কাছে বিয়ে দিবে না।

৬ বছর প্রবাস জীবন পার করার পর যখন দেশে ফিরলাম তখন বাবা মা খুব করে চাইলেন আমি যেন বিয়ে করি। আমিও ভেবে দেখলাম বয়স তো কম হলো না। তাই বিয়ে করার জন্য রাজি হলাম। আমার খালাতো ভাই সুজনকে সাথে নিয়ে এক জায়গায় মেয়ে দেখতে গেলাম। মেয়ে দেখার আগেই মেয়ের বাবা আমায় বললো, -” দুবাইতে তো তোমার রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আছে তাই না?” আমি মুচকি হেসে বললাম, বিদেশে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করা অনেক ব্যয়বহুল। নিজে ব্যবসা করার মত এতো টাকা আমার এখনো হয় নি। মেয়ের বাবা অবাক হয়ে বললো, -”ঘটক যে বললো তোমার সেখানে নিজের রেস্টুরেন্ট আছে?” আমি তখন বললাম, উনি মিথ্যা বলেছেন। বিদেশে আমার নিজের কোন রেস্টুরেন্ট নেই বরং আমি একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করি। মেয়ের বাবা রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, -”আমি আমার মেয়েকে কোন কামলার কাছে বিয়ে দিবো না। সাহস কত বড়! বিদেশ গিয়ে কামলাগিরি করে দুইটাকা ইনকাম করেছে বলে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে আসছে। তোমরা এখন আসতে পারো।” আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে গেলাম।

 বাসায় আসার পর মা আর খালা যখন জিজ্ঞেস করলো মেয়ে কেমন দেখেছি তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার খালাতো ভাই মুচকি হেসে বললো, -”মেয়ে দেখার আগেই মেয়ের বাবা পাত্রকে কামলা উপাধি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে” আমি মন মরা হয়ে মাকে বললাম, মা, নেক্সট টাইম এত বড়লোক ঘরের মেয়ে না দেখে আমাদের মত নিন্মমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে দেখো।তাহলে হয়তো এতোটা অপমান করবে না। খালা তখন আমায় বললো, -"কামলাকে তো কামলায় বলবে। আমার ছেলের মতো ভালো করে পড়াশোনা করলে আজ বিদেশ গিয়ে কামলা খাটতে হতো না। তুই পরেরবার মেয়ে দেখতে গেলে আর আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে যাস না যে। তোর জন্য আমার ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলে অপমানিত হোক সেটা আমি চাই না” আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলাম। কয়েকদিন পর অর্পা নামের একটা মেয়েকে দেখতে যায়। মেয়ে আমার খুব পছন্দ হলে মেয়ের সাথে আমাকে একা কথা বলতে বলে। আমি আর মেয়ে যখন আলাদা রুমে যায় তখন মেয়ে সাথে সাথেই দরজা লাগিয়ে আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো, -"আপনাদের মত প্রবাসীদের এই এক সমস্যা। বিদেশে গিয়ে সুইপারের কাজ করবে আর দেশে এসে টাকার ফুটানি দেখিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী আর শিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে। আপনার টাকা পয়সা দেখে আমার বাবা মা গলে গেলেও আমি গলবো না। আপনি আমায় বিয়ে করলে আমি আমার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ের পরের দিন পালাবো বলে দিলাম। তাছাড়া আপনার সাহস কতবড় নিজে ইন্টার ফেল করা ছেলে হয়ে অনার্সে পড়া মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছেন?” আমি মাথা নিচু করে মেয়ের কাছে হাত জোর করে বললাম, --আমি জানতাম না আপনি অনার্সে পড়েন। জানলে আমি আসতাম না। দয়া করে আমায় আর অপমান করেন না যে। এই কথা বলে মেয়ের বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম।

 রাতে নিজের বাসায় ফিরে এসে দেখি মা, খালা আর খালাতো ভাই সোফাই বসে আছে। মা আমায় দেখে বললো, -"কিরে, মেয়ে পছন্দ হয়েছে?” আমি তখন মাকে বললাম, শুধু আমার একা পছন্দ হলে তো হবে না। আমাকেও তো মেয়ের পছন্দ হতে হবে। মেয়ে আমার মত ইন্টার ফেল করা প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। এই কথা শুনে মায়ের পাশে বসে থাকা খালা আর খালাতো ভাই হেসে দিলো। হাসতে হাসতে খালাতো ভাই আমায় বললো, -"তোমার কপালে আর বউ জুটবে না।” খালা তখন মুখ বাঁকিয়ে বললো, -"বউ জুটবে কি করে, বিদেশ গিয়ে রেস্টুরেন্টের থালা বাসন ধুলে কি আর বউ পাওয়া যাবে” আমি সচরাচর বড়দের মুখের উপর কথা বলি না। কিন্ত খালার বারবার অপমান করে কথা বলা আমার সহ্য হচ্ছিলো না। তাই একটু রেগে গিয়েই খালাকে বললাম, হার্ট ব্লক হয়ে যখন হাসপাতালে পড়ে ছিলেন তখন এই কামলায় কামলাগিরি করে আপনাদেরকে দুইলাখ টাকা পাঠিয়েছিলো অপারেশনের জন্য। আপনার ছেলের আইফোনের শখ পূরণ করেছিলো এই কামলায় কামলাগিরি করে। আমি জানি এই দেশের মানুষের চোখে আমরা সকল প্রবাসীরা কমলা। তাই দয়া করে বারবার কামলা কামলা বলে সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে না আমার কথা শুনে খালাতো ভাইটা রেগে গিয়ে বললো, "দুইলাখ টাকা আর একটা আইফোন দিয়েছো বলে আমার মাকে যা তা বলে অপমান করতে পারো না। সময় হলে তোমার টাকা আর ফোন তোমার মুখে ছুড়ে মারবো।” আমি আমার খালাতো ভাইকে কিছু না বলে শুধু একটু হাসলাম। পরদিন সকালে মাকে ডেকে বললাম, --মা, আমি এখন বিয়ে করবো না। আরো কয়েক বছর প্রবাসে কামলাগিরি করে আসি তারপর একেবারে দেশে এসে বিয়ে করবো।


  ৪বছর পরের ঘটনাঃ- আমি দেশে এসেছি শুনে আমার খালা আর খালাতো ভাই আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। খালা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, -"তুই যেখানে জব করিস সেখানে সুজনের একটা কাজের ব্যবস্থাব করে দিতে পারবি। পাস করার পর তিন বছর ধরে বেকার ঘুরছে কোথাও কোন চাকরি পাচ্ছে না।” আমি হেসে খালাকে বললাম, --তোমার শিক্ষিত ছেলে বিদেশ গিয়ে কামলাগিরি করবে তোমার খারাপ লাগবে না ? পরে তো নিজের ছেলের জন্য বউ খুঁজে পাবে না। খালা আমার কথা শুনে চুপ হয়ে আছে। আমি তখন খালাতো ভাইটাকে বললাম, নিজে যখন কষ্ট করে টাকা ইনকাম করবি তখন অন্য কারো মুখে টাকা ছুড়ে ফেলবার ইচ্ছে হবে না। খালা আর খালাতো ভাইটা আমার কথা শুনে মাথা নিচু করে আছে। আমি আর কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।

 একটা বিষয়ে পরামর্শের জন্য এক পরিচিত উকিলের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি ঐ আংকেল যার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে গিয়ে ছিলাম বলে আমাকে অপমান করে বের করে দিয়েছিলো উনি উলিকের সাথে কথা বলছে। আংকেল চলে গেলে আমি উকিলকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি এইখানে এসেছিলো কেন ? উকিল তখন বললো, "উনার মেয়ের ডিভোর্সের বিষয় কথা বলতে। অনেক বড় ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু জামাইটা নেশাখোর। মেয়েকে অত্যাচার করে বলে মেয়ে সংসার করতে চাইছে না" তার কয়েকদিন পর বাসায় বসে খবরের কাগজ পড়ছি। হঠাৎ একটা লেখা দেখে চোখটা আটকে গেলো। “স্বামীর পরকীয়ার জের ধরে স্ত্রীর আত্মহত্যা” ফ্যানে ঝুলন্ত লাশটার দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা অর্পা। আমি প্রাবাসী দেখে যে মেয়েটা আমায় অপমান করেছিলো। আমি পত্রিকা বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম, দ্য ডেইলি স্টারের একটা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২০ সালে করোনা মহামারীতেও বাংলাদেশের প্রবাসীরা ২২ বিলিয়ন ডলার অর্জন করেছে। অথচ তবুও বাংলাদেশের বেশিভাগ মানুষ প্রবাসীদের কামলার চোখে দেখে। নিজের মেয়েকে নেশাখোর ছেলেদের সাথে বিয়ে দিবে তবুও প্রবাসীদের কাছে বিয়ে দিবে না। বদ চরিত্রের প্রেমিককে বিয়ে করবে তবুও প্রবাসীদের বিয়ে করতে চাইবে না ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.